বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
জাতীয় সংসদে ভাষণ দেন। এখানে তার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা হলো
আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দেয়। কাজেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলার স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটা যোগসূত্র রয়েছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শামসুল হক সাহেব ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু তখন রাজবন্দি, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আমাদের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু সাহেব চমৎকারভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরেছেন যে, বাঙালির যা কিছু অর্জন তা কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতেই হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে জাতির পিতা ৬ দফা দেন। এই ৬ দফা বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ। ৬ দফা নিয়ে যখন তিনি সমগ্র বাংলাদেশে সফর শুরু করেন, তখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে তাঁকে মুক্ত করেন। ১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করে। কিন্তু মিলিটারি জান্তা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সেই সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণে বলেন_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এই ভূখণ্ডের নাম 'বাংলাদেশ', এটিও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে সেটাও তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন। এমনকি আমাদের জাতীয় পতাকা কী ধরনের, সেই সবুজের ভেতরে যে লাল সূর্য থাকবে, সবুজ জমিনে লাল সূর্য উঠবে, তাও কিন্তু জাতির পিতারই করে দেওয়া। ২৫ মার্চ যখন পাক হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখনই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত প্রস্তুতি_ কোথায় গেরিলাদের ট্রেনিং হবে, কীভাবে অস্ত্র আসবে, কীভাবে যুদ্ধ হবে, সব পরিকল্পনাই তিনি করে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মাত্র ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান দিয়েছেন। সেই সংবিধানে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা যেমন বলেছেন, মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে এবং আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রের নীতিমালা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়ে গেছে। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ অর্জন করা_ জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথ থেকে শুরু করে প্রতিটি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বঙ্গবন্ধুই করে গিয়েছেন। আমাদের যে বিশাল সমুদ্রসীমা এবং এই সীমায় আমাদের যে অধিকার, সেই অধিকারও জাতির পিতা করে দিয়ে গেছেন, সেই সমুদ্র আইনও করে দিয়ে গেছেন। স্থল সীমানা চুক্তি আইনও তিনি করে গেছেন। আমরা যদি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দেখি, '৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম। এর পর যে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনেও কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। '৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পাকিস্তানের যে শাসনতন্ত্র সেটাও আওয়ামী লীগ সরকারই প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ তো বটেই, আমি যদি পাকিস্তানের ইতিহাস ধরি, তাহলে বারবার দেখা যায় সেখানে কখনও গণতন্ত্রচর্চা হতে দেয়নি। বারবার মিলিটারি ডিকটেটর আসছে। আর আওয়ামী লীগ ৪টি মিলিটারি ডিকটেটরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। বঙ্গবন্ধু একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন, তখন একটা টাকাও রিজার্ভ মানি নেই। গোলায় একটুও খাদ্যশস্য নেই। রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক কোটির ওপর মানুষ শরণার্থী, লাখো মা-বোন যারা ইজ্জত হারায়, শহীদ পরিবারসহ সকলের কথা তিনি চিন্তা করেছেন। প্রত্যেককে তিনি সহযোগিতা করেছেন। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো সহযোগিতা করেছে। এভাবে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন। আজকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগ অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো তখন বাস্তবায়িত করা গেলে আমরা বহু আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারতাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যার পর আওয়ামী লীগের ওপর আবার নির্যাতন নেমে আসে।
মাননীয় স্পিকার, এ হত্যাকাণ্ডের পরে ক্ষমতায় কারা আসে। ঠিক যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, যারা বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক এটা যারা চায়নি, তারাই মূলত ক্ষমতায় এসেছিল। বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জেল খেটেছে। এর মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ টিকে থেকেছে। বাংলাদেশের মানুষকে বারবারই এক একটি ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সবসময় জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করেছে, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে এ সরকার শপথ গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাজউদ্দীন আহমদকে।
জাতির পিতা হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন, সেহেতু সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করি। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শাসনভার হাতে নেন। শাসনভার হাতে নিয়েই তিনি পার্লামেন্টে প্রথম সংবিধান উপহার দেন।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের এগোতে হয়েছে। আমাদের ওপর বারবার আঘাত এসেছে; কিন্তু এই দেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সব সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। শহীদের তালিকাও যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব যে, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরাই জীবন দিয়ে গেছে এ দেশের মানুষের প্রতিটি সংগ্রাম, আন্দোলন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান এরপর জেনারেল জিয়ার অবৈধ ক্ষমতা দখল, এরপর জেনারেল এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখল, তারপর বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষমতা দখল আমরা দেখেছি। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পরই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করেন, যে নির্বাচন জনগণ মেনে নেয়নি। জনগণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইলেকশন হয়, ৩০ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন। অর্থাৎ প্রতিটি মিলিটারি ডিকটেটর এবং সেই এক মিলিটারি ডিকটেটরের স্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন। প্রত্যেকটি সরকারের যেসব গণবিরোধী কর্মকাণ্ড তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল আওয়ামী লীগ এবং প্রতিটি আন্দোলনে জয়লাভ করেছে, জনগণের বিজয় এনে দিয়েছে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিয়েছে। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১_ এই সময়টা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটা ছিল স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের মানুষ প্রথম উপলব্ধি করে যে, সরকার জনগণের সেবক এবং সেই সেবক হিসেবেই আমরা কাজ করি। বাংলাদেশের মানুষ একটু সুখের মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু আবার সেই দুর্ভাগ্য যে, ২০০১ সালের নির্বাচনে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, এটা শুধু দেশের অভ্যন্তরে না আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এর সঙ্গে জড়িত ছিল। কারণ আমার অপরাধ ছিল, আমি দেশের সম্পদ গ্যাস অন্য দেশের কাছে বিক্রি করতে চাইনি। যেহেতু আমার দেশের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দিতে চাইনি, আর অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়া এই গ্যাস দিতে মুচলেকাও দিয়েছিলেন। যার ফলে আমরা সরকারে আসতে পারিনি। ভোট বেশি পেয়েছিলাম, সিট পেলাম না, সরকার গঠন করতে পারলাম না। এরপর ৭টি বছর যে অত্যাচার, নির্যাতন এ দেশের মানুষের ওপর চলেছে, আমার ২১ হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে। ঠিক '৭১ সালে যেভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত নিয়েছে, একই কায়দায় ২০০১ থেকে ২০০৬_ এ দেশে যেন সেই গণহত্যারই আর একটি রূপ আমরা দেখেছি। দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড, নানা ধরনের ঘটনা, যার ফলাফল আবার ইমার্জেন্সি। এর বিরুদ্ধেও কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বসে থাকেনি। এ দেশের শিক্ষক সমাজ, ছাত্র সমাজ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি কিন্তু আন্দোলন করেছে। যার ফলে আবার আমরা গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি।
মাননীয় স্পিকার, আজকে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। এক একটা দলের একটি নীতি থাকে। আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে_ জাতির পিতা পথ দেখিয়ে গেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত করে উন্নত জীবন দেবেন, এটাই ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। আমরা সরকারে থাকি বা বিরোধী দলে থাকি না কেন, জনগণের কল্যাণ কীভাবে করব, সব সময় সেই পরিকল্পনাই নিয়ে কাজ করছি। সেখানে যখন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজন হয়, তখন আন্দোলন-সংগ্রাম করি। আবার যখন আমরা সরকারে থাকি, তখন জনগণের উন্নয়নে যেভাবে কাজ করা দরকার, সেভাবেই কাজ করি। আমরা যেহেতু ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছি, সেহেতু আমাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আছে বলেই সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি। যে কারণে আজকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করেছি, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের জনগণ এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছে_ যেটা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন।
মাননীয় স্পিকার, জাতির পিতা যে কাজগুলো হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে স্থল সীমানা চুক্তি আমরা বাস্তবায়ন করেছি। আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করেছি। আগে বাংলাদেশকে অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হতো। ইনশাাল্লাহ, আজকে অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয় না। আমরা বাজেটের ৯০ ভাগই ব্যয় করি নিজস্ব অর্থায়নে। এই সক্ষমতা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, সেটাও পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। কোনো দেশে যখন কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং সেখানে যেসব মিত্রশক্তি সহযোগিতা করেছে, তারা কিন্তু সেসব দেশে ঘাঁটি বানিয়ে থেকে গেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র ব্যতিক্রম। বঙ্গবন্ধুর মতো স্বাধীনচেতা নেতা ছিল বলেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই সেই মিত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। ভারতের যে সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করেছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, 'আপনার সেনাবাহিনী কবে ফিরিয়ে নিবেন?' ইন্দিরা গান্ধীও একজন স্বাধীনচেতা নেতা ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং তাঁর মিত্র বাহিনীকে তাঁর দেশে ফেরত নিয়ে গেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা কিন্তু কখনও হয়নি। পশ্চিম জার্মানিকে যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা সাহায্য করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও সেখানে বহুদিন আমেরিকান সৈন্যের ঘাঁটি ছিল। পূর্ব জার্মানিকে সাহায্য করেছিল রাশিয়ান সৈন্য এবং সেখানেও রাশিয়ার ঘাঁটি ছিল। জাপানে এখনও আমেরিকার ঘাঁটি রয়ে গেছে। এ রকম বহু দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে যে, যারা মিত্রশক্তি হিসেবে কোনো দেশে একবার ঢুকেছে তারা ফেরত যায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো দৃঢ়চেতা ও স্বাধীনচেতা নেতা ছিলেন বলেই স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বাংলাদেশ থেকে সেই মিত্রশক্তি তাঁর দেশে ফিরে গেছে।
আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। এ বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বসভায় সব সময় মাথা উঁচু করে চলতে চাই। আমি এটুকু বিশ্বাস করি, আমরা সরকার গঠনের পর থেকে যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছি, শুধু তাই না বঙ্গবন্ধু যে পররাষ্ট্র নীতি আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।' আমরা সেই নীতি সম্পূর্ণভাবে মেনে চলছি বলে পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। এটিও খুব কম দেশই পারে। এমনকি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমরা যে সমস্যাবলির সমাধান করেছি, সেটিও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই। আমাদের সমুদ্রসীমা, স্থলসীমা সবকিছু আমরা সমাধান করেছি। গঙ্গা পানি চুক্তিও আমরা করেছি। অর্থাৎ সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে কীভাবে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব, সেটিই আমাদের একমাত্র চিন্তা। সেই চিন্তা নিয়েই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। যার সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে। আমরা কী পেলাম না পেলাম সেই চিন্তা আমি করি না। শুধু একটিই চিন্তা যে, এ দেশ আমার পিতা স্বাধীন করে গেছেন। তিনি এ দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে সারা জীবন তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এ দেশের মানুষকে কীভাবে তাঁদের দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা করবেন, তাঁদের একটু বাসস্থানের ব্যবস্থা করবেন, তাঁরা যেন ছিন্ন বস্ত্রে না থাকে তার সমাধান করবেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবকিছু তিনি কীভাবে দেবেন_ এই চিন্তাটাই সবসময় তাঁর মাথায়। কাজেই তাঁর কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেটিই চেষ্টা করেছি দেশের মানুষের কল্যাণের কাজে লাগাতে। আজকে বাংলাদেশের মানুষ অন্তত পেট ভরে খেতে পারছে, হতদরিদ্র যারা, আমরা বিনা পয়সায় খাদ্য সাহায্য দিচ্ছি। আমাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এবং আমাদের সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ ভালো থাকবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে, প্রতিটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখবে, চিকিৎসা পাবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে, মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ, এখন সমগ্র বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস। সকলের হাতে মোবাইল। প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা বহুদূর এগিয়ে গেছি। এটি জাতির পিতার যে স্বপ্ন ছিল, এই বাংলাদেশটিকে নিয়ে যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলবে, আমি বিশ্বাস করি আমরা ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করব এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত দেশ। একই সঙ্গে আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদবিরোধী যে কার্যক্রম নিচ্ছি, তার ফলে বাংলাদেশে আজকে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা যাতে বিরাজ করে সেই পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করছি। সেখানে দেশবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ কিছু লোক সবসময় একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ যেভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, সুরক্ষিত করেছে এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা যেন দেশকে এভাবে এগিয়ে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটিই কামনা করি।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দেয়। কাজেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলার স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটা যোগসূত্র রয়েছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শামসুল হক সাহেব ছিলেন সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু তখন রাজবন্দি, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আমাদের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু সাহেব চমৎকারভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস তুলে ধরেছেন যে, বাঙালির যা কিছু অর্জন তা কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতেই হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে জাতির পিতা ৬ দফা দেন। এই ৬ দফা বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ। ৬ দফা নিয়ে যখন তিনি সমগ্র বাংলাদেশে সফর শুরু করেন, তখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে তাঁকে মুক্ত করেন। ১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করে। কিন্তু মিলিটারি জান্তা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দেয়নি। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সেই সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণে বলেন_ 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এই ভূখণ্ডের নাম 'বাংলাদেশ', এটিও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে সেটাও তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন। এমনকি আমাদের জাতীয় পতাকা কী ধরনের, সেই সবুজের ভেতরে যে লাল সূর্য থাকবে, সবুজ জমিনে লাল সূর্য উঠবে, তাও কিন্তু জাতির পিতারই করে দেওয়া। ২৫ মার্চ যখন পাক হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখনই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত প্রস্তুতি_ কোথায় গেরিলাদের ট্রেনিং হবে, কীভাবে অস্ত্র আসবে, কীভাবে যুদ্ধ হবে, সব পরিকল্পনাই তিনি করে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মাত্র ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান দিয়েছেন। সেই সংবিধানে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা যেমন বলেছেন, মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে এবং আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রের নীতিমালা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়ে গেছে। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ অর্জন করা_ জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথ থেকে শুরু করে প্রতিটি সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বঙ্গবন্ধুই করে গিয়েছেন। আমাদের যে বিশাল সমুদ্রসীমা এবং এই সীমায় আমাদের যে অধিকার, সেই অধিকারও জাতির পিতা করে দিয়ে গেছেন, সেই সমুদ্র আইনও করে দিয়ে গেছেন। স্থল সীমানা চুক্তি আইনও তিনি করে গেছেন। আমরা যদি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দেখি, '৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম। এর পর যে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনেও কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। '৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পাকিস্তানের যে শাসনতন্ত্র সেটাও আওয়ামী লীগ সরকারই প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ তো বটেই, আমি যদি পাকিস্তানের ইতিহাস ধরি, তাহলে বারবার দেখা যায় সেখানে কখনও গণতন্ত্রচর্চা হতে দেয়নি। বারবার মিলিটারি ডিকটেটর আসছে। আর আওয়ামী লীগ ৪টি মিলিটারি ডিকটেটরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। বঙ্গবন্ধু একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন, তখন একটা টাকাও রিজার্ভ মানি নেই। গোলায় একটুও খাদ্যশস্য নেই। রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজ সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক কোটির ওপর মানুষ শরণার্থী, লাখো মা-বোন যারা ইজ্জত হারায়, শহীদ পরিবারসহ সকলের কথা তিনি চিন্তা করেছেন। প্রত্যেককে তিনি সহযোগিতা করেছেন। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো সহযোগিতা করেছে। এভাবে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন। আজকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগ অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। তিনি যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো তখন বাস্তবায়িত করা গেলে আমরা বহু আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারতাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যার পর আওয়ামী লীগের ওপর আবার নির্যাতন নেমে আসে।
মাননীয় স্পিকার, এ হত্যাকাণ্ডের পরে ক্ষমতায় কারা আসে। ঠিক যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, যারা বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক এটা যারা চায়নি, তারাই মূলত ক্ষমতায় এসেছিল। বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জেল খেটেছে। এর মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ টিকে থেকেছে। বাংলাদেশের মানুষকে বারবারই এক একটি ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সবসময় জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করেছে, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে এ সরকার শপথ গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাজউদ্দীন আহমদকে।
জাতির পিতা হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন, সেহেতু সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করি। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শাসনভার হাতে নেন। শাসনভার হাতে নিয়েই তিনি পার্লামেন্টে প্রথম সংবিধান উপহার দেন।
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের এগোতে হয়েছে। আমাদের ওপর বারবার আঘাত এসেছে; কিন্তু এই দেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সব সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। শহীদের তালিকাও যদি আমরা দেখি তাহলে দেখব যে, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরাই জীবন দিয়ে গেছে এ দেশের মানুষের প্রতিটি সংগ্রাম, আন্দোলন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান এরপর জেনারেল জিয়ার অবৈধ ক্ষমতা দখল, এরপর জেনারেল এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখল, তারপর বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষমতা দখল আমরা দেখেছি। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পরই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করেন, যে নির্বাচন জনগণ মেনে নেয়নি। জনগণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইলেকশন হয়, ৩০ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন। অর্থাৎ প্রতিটি মিলিটারি ডিকটেটর এবং সেই এক মিলিটারি ডিকটেটরের স্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন। প্রত্যেকটি সরকারের যেসব গণবিরোধী কর্মকাণ্ড তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল আওয়ামী লীগ এবং প্রতিটি আন্দোলনে জয়লাভ করেছে, জনগণের বিজয় এনে দিয়েছে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিয়েছে। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১_ এই সময়টা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটা ছিল স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশের মানুষ প্রথম উপলব্ধি করে যে, সরকার জনগণের সেবক এবং সেই সেবক হিসেবেই আমরা কাজ করি। বাংলাদেশের মানুষ একটু সুখের মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু আবার সেই দুর্ভাগ্য যে, ২০০১ সালের নির্বাচনে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল, এটা শুধু দেশের অভ্যন্তরে না আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এর সঙ্গে জড়িত ছিল। কারণ আমার অপরাধ ছিল, আমি দেশের সম্পদ গ্যাস অন্য দেশের কাছে বিক্রি করতে চাইনি। যেহেতু আমার দেশের সম্পদ অন্যের হাতে তুলে দিতে চাইনি, আর অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়া এই গ্যাস দিতে মুচলেকাও দিয়েছিলেন। যার ফলে আমরা সরকারে আসতে পারিনি। ভোট বেশি পেয়েছিলাম, সিট পেলাম না, সরকার গঠন করতে পারলাম না। এরপর ৭টি বছর যে অত্যাচার, নির্যাতন এ দেশের মানুষের ওপর চলেছে, আমার ২১ হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে। ঠিক '৭১ সালে যেভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, লাখ লাখ মা-বোনের ইজ্জত নিয়েছে, একই কায়দায় ২০০১ থেকে ২০০৬_ এ দেশে যেন সেই গণহত্যারই আর একটি রূপ আমরা দেখেছি। দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড, নানা ধরনের ঘটনা, যার ফলাফল আবার ইমার্জেন্সি। এর বিরুদ্ধেও কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বসে থাকেনি। এ দেশের শিক্ষক সমাজ, ছাত্র সমাজ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি কিন্তু আন্দোলন করেছে। যার ফলে আবার আমরা গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি।
মাননীয় স্পিকার, আজকে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। এক একটা দলের একটি নীতি থাকে। আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে_ জাতির পিতা পথ দেখিয়ে গেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষকে তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত করে উন্নত জীবন দেবেন, এটাই ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। আমরা সরকারে থাকি বা বিরোধী দলে থাকি না কেন, জনগণের কল্যাণ কীভাবে করব, সব সময় সেই পরিকল্পনাই নিয়ে কাজ করছি। সেখানে যখন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজন হয়, তখন আন্দোলন-সংগ্রাম করি। আবার যখন আমরা সরকারে থাকি, তখন জনগণের উন্নয়নে যেভাবে কাজ করা দরকার, সেভাবেই কাজ করি। আমরা যেহেতু ২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছি, সেহেতু আমাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আছে বলেই সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি। যে কারণে আজকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করেছি, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের জনগণ এখন উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখছে_ যেটা ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন।
মাননীয় স্পিকার, জাতির পিতা যে কাজগুলো হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে স্থল সীমানা চুক্তি আমরা বাস্তবায়ন করেছি। আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করেছি। আগে বাংলাদেশকে অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হতো। ইনশাাল্লাহ, আজকে অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয় না। আমরা বাজেটের ৯০ ভাগই ব্যয় করি নিজস্ব অর্থায়নে। এই সক্ষমতা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, সেটাও পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। কোনো দেশে যখন কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং সেখানে যেসব মিত্রশক্তি সহযোগিতা করেছে, তারা কিন্তু সেসব দেশে ঘাঁটি বানিয়ে থেকে গেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র ব্যতিক্রম। বঙ্গবন্ধুর মতো স্বাধীনচেতা নেতা ছিল বলেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেই সেই মিত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। ভারতের যে সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করেছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, 'আপনার সেনাবাহিনী কবে ফিরিয়ে নিবেন?' ইন্দিরা গান্ধীও একজন স্বাধীনচেতা নেতা ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং তাঁর মিত্র বাহিনীকে তাঁর দেশে ফেরত নিয়ে গেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা কিন্তু কখনও হয়নি। পশ্চিম জার্মানিকে যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যরা সাহায্য করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও সেখানে বহুদিন আমেরিকান সৈন্যের ঘাঁটি ছিল। পূর্ব জার্মানিকে সাহায্য করেছিল রাশিয়ান সৈন্য এবং সেখানেও রাশিয়ার ঘাঁটি ছিল। জাপানে এখনও আমেরিকার ঘাঁটি রয়ে গেছে। এ রকম বহু দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে যে, যারা মিত্রশক্তি হিসেবে কোনো দেশে একবার ঢুকেছে তারা ফেরত যায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো দৃঢ়চেতা ও স্বাধীনচেতা নেতা ছিলেন বলেই স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বাংলাদেশ থেকে সেই মিত্রশক্তি তাঁর দেশে ফিরে গেছে।
আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করেছি। আমরা বিজয়ী জাতি। এ বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বসভায় সব সময় মাথা উঁচু করে চলতে চাই। আমি এটুকু বিশ্বাস করি, আমরা সরকার গঠনের পর থেকে যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছি, শুধু তাই না বঙ্গবন্ধু যে পররাষ্ট্র নীতি আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।' আমরা সেই নীতি সম্পূর্ণভাবে মেনে চলছি বলে পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। এটিও খুব কম দেশই পারে। এমনকি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমরা যে সমস্যাবলির সমাধান করেছি, সেটিও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই। আমাদের সমুদ্রসীমা, স্থলসীমা সবকিছু আমরা সমাধান করেছি। গঙ্গা পানি চুক্তিও আমরা করেছি। অর্থাৎ সকল দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে কীভাবে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব, সেটিই আমাদের একমাত্র চিন্তা। সেই চিন্তা নিয়েই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। যার সুফল দেশের মানুষ পাচ্ছে। আমরা কী পেলাম না পেলাম সেই চিন্তা আমি করি না। শুধু একটিই চিন্তা যে, এ দেশ আমার পিতা স্বাধীন করে গেছেন। তিনি এ দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে সারা জীবন তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং এ দেশের মানুষকে কীভাবে তাঁদের দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা করবেন, তাঁদের একটু বাসস্থানের ব্যবস্থা করবেন, তাঁরা যেন ছিন্ন বস্ত্রে না থাকে তার সমাধান করবেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবকিছু তিনি কীভাবে দেবেন_ এই চিন্তাটাই সবসময় তাঁর মাথায়। কাজেই তাঁর কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি, সেটিই চেষ্টা করেছি দেশের মানুষের কল্যাণের কাজে লাগাতে। আজকে বাংলাদেশের মানুষ অন্তত পেট ভরে খেতে পারছে, হতদরিদ্র যারা, আমরা বিনা পয়সায় খাদ্য সাহায্য দিচ্ছি। আমাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এবং আমাদের সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ ভালো থাকবে, সুন্দরভাবে বাঁচবে, প্রতিটি ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখবে, চিকিৎসা পাবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে, মেধা বিকাশের সুযোগ পাবে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ, এখন সমগ্র বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস। সকলের হাতে মোবাইল। প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা বহুদূর এগিয়ে গেছি। এটি জাতির পিতার যে স্বপ্ন ছিল, এই বাংলাদেশটিকে নিয়ে যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলবে, আমি বিশ্বাস করি আমরা ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করব এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত দেশ। একই সঙ্গে আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদবিরোধী যে কার্যক্রম নিচ্ছি, তার ফলে বাংলাদেশে আজকে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা যাতে বিরাজ করে সেই পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করছি। সেখানে দেশবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ কিছু লোক সবসময় একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। সকল ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ যেভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, সুরক্ষিত করেছে এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা যেন দেশকে এভাবে এগিয়ে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটিই কামনা করি।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
0 comments:
Post a Comment