৩৬ বছর ছুটিবিহীন !
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পুরো চাকরিজীবনই ছুটিবিহীন কাটিয়েছেন এক শিক্ষক। ৩৬ বছর ধরেই তিনি ছুটি না নিয়েই শিক্ষকতা করছেন। পরিবার-পরিজনকে সময় না দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। আর তাই তিনি এলাকার মানুষের কাছে খ্যাত হয়ে উঠেছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আদর্শ শিক্ষক হিসেবে।গণিত-বিজ্ঞানের স্বনামধন্য এই শিক্ষকের নাম স্বপন কুমার চক্রবর্তী। তিনি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের
ঐতিহ্যবাহী আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তিনি উপজেলা সদরের পূর্ব নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা।
নিজে ডাক্তার হতে পারেননি বলে আক্ষেপ নেই। নিজের হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষার্থী আজ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বড় প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তা। মানুষ গড়ার কারিগরের নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উজাড় করার গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে ফেরে। স্থানীয় অভিভাবকেরা মনে করেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা স্বপন চক্রবর্তীর মতো নিষ্ঠাবান হলে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দৃশ্যপট বদলে যেত।
স্বপন কুমার চক্রবর্তী ১৯৫৭ সালে নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বর্তমান কর্মস্থল আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশন থেকেই মাধ্যমিক পড়া শেষ করেন। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই তিনি এই স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন। এইচএসসি পাস করার পর ১৯৭৯ সালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।
মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি এলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হাই মিঞা তাকে স্কুলে আসার জন্য খবর দেন। এক সন্ধ্যাবেলা বিদ্যালয়ের এক কোনে নির্জনে ডেকে নিয়ে হাই স্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,‘স্বপন, তুই স্কুল থেকে চলে গেলে আমার স্কুলটা অচল হয়ে যাবে। শীতের দেশ রংপুরে তোর ডাক্তারি পড়ার দরকার নাই।’ স্যারের কথা তিনি উপেক্ষা না করে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে শিক্ষকতায় ফিরে এলেন। তা ছাড়া, বাবা শিবনাথ চক্রবর্তীও চাইতেন ছেলে শিক্ষকতা করুক।
১৫ অক্টোবর ১৯৭৯ সালে তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮০ সালে এমপিওভুক্ত হন। পরে তিনি বিএসসি ও বিএড কোর্স সম্পন্ন করেন। ২০১০ সালে তিনি একই বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। চাকরিজীবনে তার ছুটির ঘণ্টা পড়েছে। আর মাত্র চার মাস পরে তিনি চাকরি থেকে অবসরে যাবেন।
৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এক দিনও প্রাপ্য নৈমিত্তিক ছুটি কাটাননি তিনি। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার ও নির্দিষ্ট ছুটির দিন বাদে রোজ স্কুলে গেছেন মহম্মদপুর উপজেলা সদরের আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশনের এই শিক্ষক। বাবার মৃত্যু, স্ত্রীর অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ- কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। স্কুলের হাজিরা বই ও অন্যান্য কাগজপত্র ঘেঁটে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
স্মৃতি হাতড়ে শিক্ষক স্বপন কুমার জানান, ১৯৮৫ সালের আগস্টের কোন এক শনিবার। স্কুলে যাওয়ার আগে পুকুরে গাসল করতে নেমেছিলেন। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে শামুকে পা কেটে যায়। পুকুরের পাড়ে উঠে রক্ত বের হওয়া দেখে তিনি জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফেরার পর সবাই তাকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেন। তারপরও ১১টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই ক্লাসে পৌঁছাতে পেরেছিলেন সেদিন। এ রকম অসংখ্য ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন তিনি।
বাবা শিবনাথ চক্রবর্তী মারা যান ১৯৯৬ সালের ২১ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে। দিনটা ছিল শুক্রবার। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে পরদিন শনিবার সময়মতো স্কুলে হাজির হন স্বপন চক্রবর্তী।
পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। একটু জিরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘প্রথম সন্তানের জন্ম হয় বাড়িতে। ছেলে হওয়ার খবর শুনে মনে সে কী আনন্দ! ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ছুটে যাই। কিন্তু স্কুল তো খোলা। তাই ছুটির পর গিয়ে দেখে আসি ফুটফুটে ছেলেটাকে।’
মহম্মদপুর উপজেলা সদরে আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০ সালে। স্বপন চক্রবর্তীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আশির দশক থেকে বিদ্যালয়ের সুনাম চারদিক ছড়িয়ে পড়ে। আজও সে সুনামের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। উপজেলায় সরকারি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। বরাবরই এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জেএসসি ও এসএসসি ভালো ফল করে আসছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সেরা স্কুলের তালিকায় রয়েছে।
১৯৮১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে বিজ্ঞান বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান লাভ করে এই স্কুলেরই ছাত্র আকবর রেজাউল হায়দার। ১৯৯৪ সালে মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান লাভ করে এই স্কুলের দীপঙ্কর বিশ্বাস। এসব শিক্ষার্থী স্বপন স্যারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ছিলেন বলে তাদের অভিভাবকেরা জানান।
স্ত্রী রেখা চক্রবর্তী ও তিন ছেলে নিয়ে স্বপন চক্রবর্তীর সংসার। তিন ছেলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বড় দুই ছেলে শরদিন্দু চক্রবর্তী, সৌমিত্র চক্রবর্তী দর্শন ও পরিসংখ্যান বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করেছেন। ছোট ছেলে শোভন চক্রবর্তী নাট্যতত্ত্ব বিষয়ে পড়ালেখা করছেন। ছেলেরাও বাবার মতো অত্যন্ত মেধাবী।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘স্বপন কুমার চক্রবর্তী এ জনপদের আলোর দিশারি। নিজের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিমধ্যে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে বিদ্যালয়ে টানা সময় দিচ্ছেন। ৩৬ বছরের বেশি চাকরিজীবনে এক দিনও ছুটি নেননি তিনি। তার এই ত্যাগ অনুসরণযোগ্য।’
স্বপন চক্রবর্তীর ছাত্র বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম রেজাউল করিম বলেন, ‘গণিত-বিজ্ঞানের পাশাপাশি সকল বিষয়ে স্যারের অগাধ পাণ্ডিত্য রয়েছে। স্বপন স্যার সারা জীবন শিক্ষার্থীদের পেছনে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বিনিময়ে কী পেলেন, কী পেলেন না, তার হিসাব মিলিয়ে দেখেননি কখনো। স্যারকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আরেক শিক্ষক শহিদুর রহমান স্বপন স্যারের ছাত্র।
শহিদুর রহমান স্বপন বলেন,‘স্যারের অনুপ্রেরণা ও কার্যকরী পাঠদানের ফলেই আমরা এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি। হাটে-মাঠে-ঘাটে যেকোনো সমস্যা নিয়ে আমরা হাজির হয়েছি। স্যার সমাধান করে দিয়েছেন।’
কথা হয় তার স্ত্রী রেখা চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সময়মতো তিনি স্কুলে গিয়ে হাজির হন। রান্না একটু দেরি হলে, না খেয়েই চলে যান। কখনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার দরকার হলে বন্ধের দিন যান। লোকে যখন তার প্রশংসা করে তখন আমারও গর্ব হয়।’
স্বপন চক্রবর্তী বলেন, ‘৩৬ বছরে ৭২০ দিন আমার প্রাপ্য ছুটি নিইনি। এই ৭২০ দিন শিক্ষার্থীদের বেশি পড়াতে পেরেছি। আমরা যদি অযথা ছুটি না নিয়ে কাজ করি, তবে দেশ এগিয়ে যাবে। কী পেলাম, কী পেলাম না, তার হিসাব কখনো করিনি। ’
বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জুবায়ের রহমান ও মুশফিকা রহমান বলেন, ‘স্বপন স্যার বিদ্যালয়ের অন্য সব শিক্ষকের চেয়ে আলাদা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা স্যারকে এক দিনও অনুপস্থিত দেখিনি ।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বপন চক্রবর্তী সরাসরি আমার স্যার। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এখন পর্যন্ত ৩৬ বছরের চাকরিজীবনে স্যারকে ছুটি নিতে দেখিনি। এমন নজির অন্য কোথাও আছে কি না জানা নেই। এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।’
0 comments:
Post a Comment