নোবেল বিজয়ী আবিষ্কার
মস্তিষ্কের জিপিএস
বর্তমান সময়ে কাউকে যদি অচেনা কোথাও যেতে বলা হয়, মুহূর্তের মধ্যে সে স্মার্টফোন হাতে নিবে। খুঁজে বের করবে পথের নিখুঁত ম্যাপ। জিপিএস (Global Positioning System) নামে যে শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেটি বিভিন্ন স্থান ও পথের ন্যূনতম দূরত্ব খুঁজে পেতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন জিপিএস ছিল না, তখনো মানুষ যাতায়াত করত প্রতিদিন। এমনকি
এখনো, সব জায়গায় যেতে আমরা জিপিএস কিংবা ম্যাপ ব্যবহার করি না।
বাহান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহরে একটি রিকশাওয়ালা কিংবা ট্যাক্সিচালক অনায়াসে চলে যায় বকশীবাজার থেকে মগবাজার কিংবা চানখাঁরপুল থেকে হাতিরপুল। যে পথে আপনি বহু বছর যাতায়াত করেননি, সে পথেও হঠাৎ একদিন গেলেই, অনেক পরিচিত মনে হয়। আমরা কি কখনো ভেবেছি, কীভাবে অনেক জায়গার কথা আমাদের মনে থাকে! কখনো কি মনে হয়েছে, এত এত পথই বা চলছি কেমন করে প্রতিদিন। শুনতে হয়তো খুব উদ্ভট শোনায়। কিন্তু এই জিজ্ঞাসা খুবই আদিম।
আমরা ধরেই নিয়েছি যে আমাদের এই গমনাগমনের ক্ষমতাটা এমনিতেই হয়ে যায়। অনেক দার্শনিকও এই বিষয়টিকে একটি সহজাত ক্ষমতা (Innate Ablity) হিসেবে মনে করতেন। যা আপনা-আপনি হয়ে যায়। আসলে কি তাই? আমাদের শরীরের সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। মস্তিষ্কের বহু প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে অনেক আগেই। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে মূলত যুক্তি দিয়ে। সেগুলো ছিল তত্ত্বভিত্তিক উত্তর। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা (Scientific Experiment) ভিত্তিক প্রমাণ ছিল না। বিশ শতকে এসে মস্তিষ্ক নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাভিত্তিক গবেষণা বাড়তে থাকে। বিজ্ঞানীরা ভাবতে থাকেন, মানুষের এই যে স্থান থেকে স্থানে গমনাগমনের বিষয়টি, সেটা কি আসলেই আপনা-আপনি প্রক্রিয়া (Cognitive Function), নাকি মস্তিষ্কের কোনো নির্দিষ্ট অংশ এর জন্য দায়ী।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে জন ও’কিফ (Jhon O’keefe) নামক একজন বিজ্ঞানী দারুণ এক তথ্য প্রকাশ করেন। তার পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রমাণিত হয়, আমাদের মগজের কিছু নির্দিষ্ট কোষ (Cells) বিভিন্ন স্থান ও পারিপার্শ্বিকতাকে মনে রাখে। এগুলোর নাম দেওয়া হয় স্থানিক কোষ (Place Cells)। এই কোষগুলো মস্তিষ্কের যে অংশে থাকে তার নাম হিপোক্যম্পাস (Hippocampus)। অন্যদিকে, নব্বইয়ের দশকে, মাই-ব্রিট (May-Britt Moser) ও এডভার্ট (Edvard I. Moser) দম্পতি গবেষণা করে আরও চমৎকার এক তথ্য পান। তারা বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের কিছু কোষ আমাদের পরিচিত জায়গাগুলোতে গমনে সাহায্য করে। এই কোষগুলো কম্পাসের মতো তৈরি করে এক নিখুঁত ম্যাপ। এই কোষগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে গ্রিড সেল (Grid Cells)। মগজের যে অংশে গ্রিড সেল পাওয়া যায় সেটির নাম এন্টরহিনাল করটেক্স (entorhinal cortex)। খুব চমৎকার বিষয় হলো, প্লেইস সেল ও গ্রিড সেল সমন্বিতভাবে কাজ করে। আমাদের মগজে তৈরি করে রাখে একটি ম্যাপ। ঠিক যেমন একটি কাগজের ম্যাপ বা ফোনের জিপিএস। মস্তিষ্কের প্লেইস সেল ও গ্রিড সেলের সমন্বিত সিস্টেমের নাম দেওয়া হয়েছে, ইনার ব্রেইন জিপিএস (Inner Brain GPS)। এই আবিষ্কারই উল্লিখিত বিজ্ঞানীদের এনে দিয়েছে ২০১৪ সালের চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেল মুকুট।
ঢাকার রিকশাওয়ালার জিপিএস দরকার হয় না। তার মাথার প্লেইস সেল ও গ্রিড সেলই যথেষ্ট। প্লেইস সেল ও গ্রিড সেল অনেকেরই নষ্ট হয়ে যায়। তারা তখন জায়গা ভুলে যায়, ভুলে যায় পথও। কপালকুণ্ডলার নায়ক নবকুমার অকস্মাৎ শুনিল, পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ! পথিক পথ হারাতে পারে, যদি সে পথ একেবারেই অচেনা হয় অথবা তার মস্তিষ্কের প্লেইস সেল ও গ্রিড সেল সঠিকভাবে কাজ না করে।
এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্য দিয়ে মিলেছে আদিম এক জিজ্ঞাসার বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ। এ ছাড়া মস্তিষ্ক জড়িত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার উন্নতির জন্য এ গবেষণার ফল সহায়ক হবে। উল্লেখ্য, মস্তিষ্কের এই ধরনের কোষগুলো (Cells) শুধু মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান নয়। অন্যান্য অনেক মেরুদণ্ডি প্রাণীর মস্তিষ্কেও পাওয়া যায়। আমাদের পালিত কুকুর যে পথ হারিয়ে বাসায় ফিরে আসে, সেটাই কি তার প্রমাণ নয়?
*লেখক গবেষক, স্টকহোম ইউনিভার্সিটি, সুইডেন। ইমেইল: <redoxrouf@yahoo.com>
0 comments:
Post a Comment