advertisement

adverisement

your javascript ads here

Friday, 8 July 2016

সংখ্যালঘুদের জমি দখলে নেমেছেন সাংসদ !

সংখ্যালঘুদের জমি দখলে নেমেছেন সাংসদ !

 ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ দবিরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে মাজহারুল ইসলাম ওরফে সুজনের বিরুদ্ধে স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল, তাদের ওপর হামলা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিত ব্যক্তিদের মধ্যে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের এক নেতার পরিবারও আছে।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে
পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন; হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।তবে সাংসদ দবিরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে মাজহারুল জমি দখল, নির্যাতন বা হুমকি দেওয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন ও স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, সাংসদ দবিরুল ইসলাম তাঁর সংসদীয় আসনের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের রনবাগ নামক স্থানে রনবাগ ইসলামী টি এস্টেট কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি চা-বাগান গড়ে তুলেছেন। ১০৬ একর আয়তনের ওই বাগানের মাঝখানে অকুল চন্দ্র সিংয়ের ২১ বিঘা জমি, ভাকারাম সিং ও জনক চন্দ্র সিংয়ের ২৭ বিঘা জমি, থোনরাম সিংয়ের ২৪ বিঘা, ক্ষুদনলালের ২৪ বিঘা চা-বাগানসহ ১০টি হিন্দু পরিবারের চা-বাগান ও আবাদি জমি রয়েছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে অকুল চন্দ্র সিংয়ের এক বিঘা জমি অন্য সংখ্যালঘুদের জমিতে যাওয়ার পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। করিডোরের মতো এই এক বিঘা জমি দখল হয়ে গেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁদের নিজ জমিতে যাওয়ার আর কোনো পথ পাবেন না। কারণ, তাঁদের জমি ও বাগানের চারপাশ ঘিরে আছে সাংসদের চা-বাগান। অকুল চন্দ্রের এই এক বিঘাসহ বাগানের জমি দখল করতে পারলে সংখ্যালঘু ১০ পরিবারের সব জমি কবজা করা সহজ হবে সাংসদের জন্য।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংসদের মদদে তাঁর ছেলে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে চা-বাগানের ১৫০ থেকে ২০০ বিঘা জমি সাংসদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করতে চাইছেন। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে তাদের হুমকি দেওয়া ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। সর্বশেষ তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ জুন অকুল চন্দ্র সিং তাঁর এক বিঘা জমির অর্ধেকে চাগাছের চারা রোপণ করেন। কিন্তু সাংসদের লোকজন ওই দিন বিকেলেই হাল চষে চারাগুলো নষ্ট করে দেন। ১৭ জুন সাংসদের ছেলে মাজহারুল ইসলাম গিয়ে অকুল চন্দ্রকে শাসিয়ে আসেন।১৯ জুন সাংসদের ছেলের নেতৃত্বে রনবাগ ইসলামী টি এস্টেট কোম্পানি লিমিটেডের তত্ত্বাবধায়ক একরামুল হক এবং স্থানীয় মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, আশরাফুল ইসলাম, এরশাদ আলী, বাবু, মিনিসহ ২৫ থেকে ৩০ জন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র দিয়ে অকুল চন্দ্র সিং, ভাকারাম সিং ও জনক চন্দ্র সিংয়ের ওপর হামলা চালায়। এতে ভাকারাম সিংসহ আট-দশজন আহত হন। সন্ত্রাসীরা চা-বাগানের জমি সাংসদপুত্র মাজহারুল ইসলামের নামে লিখে দেওয়ার জন্য জোর করে স্ট্যাম্পে অকুল চন্দ্রের সই নেওয়ার চেষ্টা করে।ঠাকুরগাঁও জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বলরাম গুহ প্রথম আলোকে বলেন, জমি দখলের জন্যই হামলা হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ভয়ে তারা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়, আর ক্ষমতায় এলে ওই আওয়ামী লীগের নেতারাই তাদের সঙ্গে অন্যায় করে।ভাকারাম সিং প্রথম আলোকে জানান, সাংসদের সমর্থকেরা তাঁকে মারধর করার পর তিনি গত ২০ জুন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
জানতে চাইলে ভুক্তভোগী অকুল চন্দ্র সিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদ তাঁর ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আমাদের পাঁচ বিঘা জমি ইতিমধ্যে দখল করেছেন। ক্যাডার বাহিনী আমাদের মারধরও করেছে। কয়েকজন নারী-পুরুষকে গুরুতর আহত করেছে। নির্যাতনের ভয়ে কয়েকটি পরিবার ঘর ছেড়ে চলেও গেছে।’
অকুল চন্দ্র সিং বলেন, তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কয়েকবার সাংসদের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেখা করেননি। অনেক ভয়ের মধ্যে দিন পার করছেন বলে জানান তিনি।
সাংসদ দবিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা সঠিক নয়। এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। মন্ত্রিসভা রদবদলের সময় আমার নাম এসেছিল যে আমি মন্ত্রী হব। আবার আমি জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। এটা সহ্য করতে না পেরে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন চক্রান্ত করে এসব গুজব রটিয়েছেন।’
কিন্তু সাংসদপুত্র মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক উপজেলা চেয়ারম্যান আয়ূব আলী ফায়দা নেওয়ার জন্য এসব রটাচ্ছে।
সাংসদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে দিন হামলা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেদিন আমার ছেলেকে টেলিফোন করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর আমার ছেলের ওপর হামলা চালানো হয়। ও কিছুই জানত না।’
আর সাংসদপুত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওই দিন কোথাও যাইনি। ওই হামলার কথাও জানি না। বাসায় ঘুমিয়ে ছিলাম।’
অকুল চন্দ্র সিং কি তাহলে অন্য কারও হয়ে অভিযোগ করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মাজহারুল বলেন, অকুল চন্দ্র সিং শিষ্টাচার জানেন না। সবকিছুতে উত্তেজিত হয়ে যান।
আর সাংসদের সঙ্গে অকুল চন্দ্র সিংয়ের দেখা করার চেষ্টার বিষয়ে জানতে চাইলে দবিরুল ইসলাম বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যায়নি।
সাংসদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংসদের লোকজনের হামলার পর সংখ্যালঘুরা আমার বাড়িতে অভিযোগ নিয়ে এসেছিল। আমি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম।’
তেভাগা আন্দোলনের নেতা হেলকেতু সিংয়ের ছেলে বধু সিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে সাংসদ আমার চা-বাগানের ২৭ শতাংশ জমি দখল করেছেন। জমি না দিলে আমার বাগান জ্বালিয়ে দেবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিষয়টি জানে। কিন্তু কারও সাহায্য পাই না।’ হেলকেতু সিং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন।
জনক সিংয়ের ছেলে ধরেন সিং বলেন, ‘সাংসদের ছেলে প্রতি বিঘা জমির জন্য আমাদেরকে ৭০ হাজার টাকা দিতে চায়। জমি বিক্রি করব না বললে ক্যাডার বাহিনী জোর করে আমার কাছ থেকে স্টাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে।’
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য সাংসদপুত্র এবং তাঁর সমর্থকেরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালাচ্ছে। এতে বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বলে এই অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে সারা দেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁও জেলার পুলিশ সুপার আবদুর রহিম শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদিও কেউ কোনো অভিযোগ করতে আসেননি, তবু জমি দখল নিয়ে এ ধরনের হামলার কথা শুনে আমি জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানিয়েছি। এ ছাড়া এ বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য সাংসদও আমাকে অনুরোধ করেছেন।’
তবে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত ১৯ জুন থেকে পাড়িয়া ইউনিয়নের কদমতলী, সিংগারী-১, সিংগারী-২, হাইয়াপাড়া ও কামাত পাড়িয়া গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলো আতঙ্কে আছে। ভয়ে অনেকে রাতের বেলায় বাইরে থাকছেন। এসব পরিবারের নারীরা সাধারণত দিনের বেলায় খেতখামারে কাজ করেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকে তাঁরা কাজে যেতেও ভয় পাচ্ছেন।

0 comments:

Post a Comment