advertisement

adverisement

your javascript ads here

Saturday, 23 July 2016

সিলেটের প্রবাসীদের বাড়িবিলাস !!




সিলেটের প্রবাসীদের বাড়িবিলাস

গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ ঘর বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে। কৃষি জমি ক্রয়ে ব্যয় হচ্ছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। অকৃষি কাজ ও ব্যবসায়িক খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে ১২ দশমিক ২ শতাংশ। প্রবাসীদের প্রেরিত মোট অর্থের ৬৬ দশমিক ১ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে!!!



নিজস্ব প্রতিবেদক
বাড়ির প্রবেশমুখে কারুকার্যময় ফটক, চারদিকে টাইলসসমেত সীমানা প্রাচীর, ছাদ এবং আঙ্গিনায় ফুলের বাগান, বাড়ির সামনে কৃত্রিম সেতু, হেলিপ্যাড, প্রতিটি কক্ষে আলাদা আলাদা সিসি ক্যামেরা, আলাদা আলাদা এয়ারকন্ডিশন, বাড়ির ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সিমেন্টের তৈরি বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি, রয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল, মিনি পার্ক-
কী নেই বাড়িতে? আছে সবই। কেবল বাড়িতে থাকার মতো কোনো মানুষ নেই। বাড়ির মালিক প্রবাসী। তাই খালি পড়ে আছে বাড়ি। সিলেট ঘুরে শূন্য পড়ে থাকা এরমক অসংখ্য আলিশান প্রবাসী বাড়ি দেখা যাবে।
প্রবাসীবহুল অঞ্চল সিলেট। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোক ইংল্যান্ড ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন। মাঝেমাঝে দেশে বেড়াতে আসেন তারা। তাদের কেউই স্থায়ীভাবে থাকেন না দেশে। তবু দেশে গড়ে তুলেন অট্টালিকাসম একেকটি বাড়ি। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে রীতিমত প্রতিযোগীতা করে নির্মিত হয় এসব বাড়ি।
সিলেটে এমন সুরম্য অট্টালিকা গড়ার প্রতিযোগিতা চলছে গত প্রায় দুই দশক ধরে। কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করে তারা নির্মান করছেন একের পর প্রসাদসম বাড়ি। এক কথায় বলা যায়, বাড়ি নির্মান নিয়ে অনেকটা ‘বাড়াবাড়ি’ চলছে সিলেট অঞ্চলে। বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করে এইসব বাড়ি তৈরি করলেও বছরের অধিকাংশ সময়ই বাড়িগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। তত্ত্বাবধায়কদের নিয়ন্ত্রনে থাকা এসব বাড়িগুলো সৌন্দর্য্য বর্ধন ছাড়া আর কোনো কাজেই আসছে না। দিনদিন এমন ‘অট্টালিকা’ নির্মানের প্রতিযোগীতা বেড়েই চলছে সিলেটে। প্রবাসীদের বাড়ি বিলাসের কারণে সিলেটে আশানুরুপ প্রবাসী বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেটের প্রবাসীবহুল এলাকাগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রবাসীরা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের চাইতে আলিশান বাড়ি নির্মানেই অধিক আগ্রহী। প্রতিবেশি প্রবাসীদের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগীতা করে চলে এসব বাড়ি নির্মান। বাড়ি তো নয় যেনো প্রতিটিই রাজবাড়ি। অনেক বাড়ি নির্মানের কাঁচামালও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আমদানি করা। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার পাড়া মহল্লায় দেখা যাবে এমন অসংখ্য প্রাসাদসম বাড়ি। অনেক বাড়ির শুধু একটি গেট তৈরিতে খরচ হয় কোটি টাকার বেশি। বাড়ির টাইলস ও ফিটিংস সবই আসে বিদেশ থেকে। বাড়ির নকশাবিদরাও দেশের বাইরের। কিন্তু এসব বাড়ি পড়ে আছে অবহেলায় অযত্নে। বাড়ির মালিকরাও থাকেন না দেশে। বেতনভূক্ত তত্ত্বাবধায়করা বছরের পর বছর ধরে পাহাড়া দেন এই বাড়িগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২৫ লাখ সিলেটি বসবাস করছেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালিদের ৯৮ ভাগই সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীরা সিলেটে ‘লন্ডনি’ হিসেবে পরিচিত। আর এই প্রবাসীদের নির্মিত বাড়িগুলো ‘লন্ডনি বাড়ি’ হিসেবে সমাদৃত। সিলেটের গ্রামাঞ্চলের এই বিশাল আকৃতির বাড়িগুলো শুধু যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীরাই তৈরী করেন নি। অন্যান্য দেশে অবস্থানকারীরাও সম্পৃক্ত হয়েছেন বাড়ি বানানোর প্রতিযোগিতায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই বাড়িগুলোকে লন্ডনি বাড়ি হিসেবেই চিনে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রবাসীরা প্রতিযোগিতার মানসিকতা থেকেই এইসব বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কার চেয়ে কার বাড়ি বেশি সুন্দর- এমন এক প্রতিযোগিতার ফসল এইসব অট্টালিকাগুলো। প্রসাদসম এইসব বাড়ির সর্বনিম্ন নির্মান ব্যয় কোটি টাকার উপরে। ৪/৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এমন বাড়ির সংখ্যা অগনিত। ১৫/২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়িও দূর্লভ নয় সিলেটের গ্রামগুলোতে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সিলেটে এমন আলিশান বাড়ি রয়েছে পাঁচ হাজারের উপরে। যার প্রতিটির নির্মান ব্যয় এক থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত। সিলেটের বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও মৌলভীবাজারের প্রবাসীবহুল এলাকায় এইসব বাড়ির সংখ্যা বেশি।
কয়েক বছর আগে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এশিয়া ফাউন্ডেশন সিলেটের প্রবাসী অর্থের উপর একটি গবেষণা চালায়। এরপর আর কেউ এ নিয়ে গবেষণা করেনি। এশিয়া ফাউন্ডেশনের গবেষনা সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ ঘর বাড়ি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে। কৃষি জমি ক্রয়ে ব্যয় হচ্ছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। অকৃষি কাজ ও ব্যবসায়িক খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে ১২ দশমিক ২ শতাংশ। প্রবাসীদের প্রেরিত মোট অর্থের ৬৬ দশমিক ১ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিলেট শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে সিলেটের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা হয়েছে ২৩ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে সিলেটের ব্যাংকগুলোতে জমা পড়েছে ২৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা, এর বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার একটু বেশি। আর ২০১৪ সালে জমা পড়েছে ২৯ হাজার ২৮৭ কোটি আর ব্যবহৃত হয়েছে ৬ হাজার ৮, ১৩ কোটি টাকা।
এ হিসেবে দেখা যায়, ২০১২ সালে সিলেটর বিভিন্ন ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের আমানতের মাত্র ৩২ শতাংশ বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হয়। ২০১৩ সালে ব্যবহৃত অর্থের পরিমান কমে দাঁড়ায় ২৪ শতাংশে। আর ২০১৪ সালে ব্যবহৃত হয় সঞ্চয়কৃত অর্থের মাত্র ২৩ শতাংশ।
ব্যবহৃত এই অর্থের বৃহদাংশই আবার অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)-এর ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেটে মোট আমানতের মাত্র ৫.৪৯ শতাংশ শিল্পখাতে বিনিয়োগ হয়।
সিলেটের ওসমানীনগরের প্রবাসী লুৎফুর রহমান বলেন, আমরা বছর, দু’বছরে একবার দেশে আসি। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশে একটু আয়েশে থাকার জন্য ভালো করে বাড়ি বানাই। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রবাসীরা বিনিয়োগী করতে আগ্রহী থাকলে নিরাপত্তাসহ উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধার অভাবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তেমন এগিয়ে আসছেন না।
বিয়ানীবাজারের প্রবাসী আলতাফ আহমদ জানান, ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনি এবছর নিজ গ্রামে বাড়ি বানিয়েছেন। সকল প্রবাসীরাই দেশে বাড়ি বানিয়েছে। তাই সকলের সাথে তাল মিলিয়ে তিনিও একটি বাড়ি বানিয়েছেন বলে জানান আলতাফ। উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা পেলে দেশে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলেও জানান তিনি।
সিলেট ওভারসিজ সেন্টারের কর্মকর্তা শামসুল আলম জানান, প্রবাসীরা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা বাধাগস্ত হচ্ছে। তাই কেবল বাড়ি বানানোর মতো অনুৎপাদনশীল খাতেই ব্যয় করছেন তাদের অর্থ।
এ ব্যাপারে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রশাসক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সিলেটের প্রবাসীরা প্রাসাদসম বাড়ি বানানোরমত অনুৎপাদনশীল খাতে তাদের অর্জিত অর্থ ব্যয় করছেন। ফলে তারা উৎপাদনশীল খাতে প্রবাসীদের কাঙ্খিত বিনিয়োগ হচ্ছে না।

0 comments:

Post a Comment