
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার ভারত-বাংলাদেশ
সীমান্তবর্তী হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায় সাপেকাটা এক শিশুকে ভাসানো হলো ভেলায়। ছবি :
এনটিভি
সাপের কামড়ে নিহত এক শিশুকে ওঝার পরামর্শে ভাসিয়ে দেওয়া হলো নদীতে। তার
আগে সাড়ে চার বছরের শিশুটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা কলার ভেলায় তোলা হয়। সেই
ভেলায় টাঙ্গানো হয় একটি মশারিও। সঙ্গে লিখেদেওয়া হয় শিশুটির নাম-ঠিকানা।এ যেন মনসামঙ্গলের দৃশ্য। বেহুলার স্বামী লখিন্দরকে সাপে কাটার পর তার মৃতদেহও ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলে। আশা, হিন্দু পৌরাণিক এ কাহিনীর লখিন্দরের মতো শিশুটিও একদিন বেঁচে ফিরবে নিজ বাড়িতে।
আজব এ ঘটনা ঘটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গর রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায়।স্থানীয়রা জানায়, গতকাল বুধবার সন্ধ্যে বেলা হিঙ্গলগঞ্জের মধ্যমামুদপুর এলাকার বাসিন্দা সাড়ে চার বছরের বর্ষা বেরাকে ঘরের মধ্যেই সাপে কাটে। বর্ষা মধ্যমামুদপুরের শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশোনা করত। এদিন তার বাবা পেশায় প্রতিমাশিল্পী বিজুশ বেরা বাড়িতে ছিলেন না। প্রতিমা গড়ার কাজে তিনি কলকাতার কুমোরটুলিতে ছিলেন। সন্ধ্যে বেলা সাপে কামড়ানোর পর ছোট্ট বর্ষা তার মা রিঙ্কু বেরাকে বলে। সঙ্গে সঙ্গে রিঙ্কু বেরা প্রতিবেশী এক মহিলাকে নিয়ে এলাকার নারী ওঁঝা ঝড়ি মাইতির কাছে যান। ঝড়ি মাইতি সাপে কাটা ছোট্ট বর্ষাকে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে ঝাঁড়ফুঁক দেন। তারপর রাত ৮টা নাগাদ ওঁঝা জানান, বর্ষা সুস্থ হয়ে গেছে। এবার বাড়ি নিয়ে যাও।
ওঁঝার কথায় বিশ্বাস করে রিঙ্কু বেরা মেয়ে বর্ষাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ফেরার পর থেকে ক্রমশ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে বর্ষার। ক্রমশ সে নিস্তেজ হতে থাকে। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। কিন্ত ওঁঝার বাড়ি থেকে ফেরার পর মেয়ে সুস্থ হয়ে গেছে বলে নিশ্চিন্তে থাকে রিঙ্কু বেরা।রাত ৯টা নাগাদ বর্ষার অবস্থা ভয়ানক অবনতি ঘটলে তড়িঘড়ি পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে মা রিঙ্কু বেরা বর্ষাকে নিয়ে যান স্থানীয় সান্ডেল বিল এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এরই মধ্যে খবর দেওয়া হয় বর্ষার বাবা বিজুশ বেরাকে। তিনিও বেরিয়ে পড়েন কলকাতা থেকে। তবে সান্ডেল বিল এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বর্ষার শারীরিক পরিস্থিতি দেখে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় বসিরহাট হাসপাতালে। কিন্তু রাতে বর্ষাকে বসিরহাট হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। বর্ষার মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের নির্দেশ দেন তাঁরা।
এরই মধ্যে কলকাতা থেকে বর্ষার বাবা বিজুশ বেরাও উপস্থিত হন সেখানে। মেয়ের মৃতদেহ পোস্টমর্টেম করা হবে শুনে ভয় পেয়ে তারা মৃত বর্ষাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন হিঙ্গলগঞ্জের লেবুখালির এক নামকরা পুরুষ ওঝার কাছে। সেই ওঁঝা মৃত বর্ষার দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনার অনেক কসরত করে শেষমেষ হাল ছেড়ে দেন। এরপর মৃত বর্ষাকে ফের নিয়ে আসা হয় মধ্যমামুদপুর গ্রামের সেই নারী ওঁঝা ঝড়ি মাইতির কাছে। ঝড়ি মাইতি ফের কিছুক্ষণ মন্ত্র-তন্ত্র আউড়ে ছোট্ট বর্ষার মৃত্যু স্বীকার করে নেন। তারপর তিনিই নিদান দেন, বর্ষাকে লখিন্দরের মতো ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে।
সেইমতো ওঁঝার পরামর্শে বিশ্বাস রেখে মৃত বর্ষার মা রিঙ্কু বেরা ও বাবা বিজুশ বেরা আজ বৃহস্পতিবার সকালে সাপেকাটা মৃত মেয়ের জন্য ভেলা সাজায়। ভেলার উপর বিছানা সাজিয়ে মশারি টানিয়ে মৃত বর্ষাকে শুইয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে তাতে বর্ষার নাম ও বাড়ির ঠিকানাও দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সেই ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া হয় গৌড়েশ্বর নদীতে।
বর্ষার মা-বাবার আশা, লখিন্দরের মতোই একদিন বর্ষা প্রাণ ফিরে পেয়ে বাড়ি ফিরে আসবে।
তবে এই ঘটনায় হতাশ স্থানীয় শিক্ষিত বাসিন্দারা। বর্ষাদের প্রতিবেশী সুশান্ত মাইতি জানান, স্রেফ কুসংস্কারের জন্য মরতে হলো বর্ষাকে। ওকে যদি আগে থাকতে ওঁঝার কাছে না নিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া যেত, তাহলে হয়তো প্রাণে বেঁচে যেত সে।
এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
0 comments:
Post a Comment